স্বদেশ ডেস্ক
নিত্যপণ্যের উত্তাল বাজারে তেলের গরম ছ্যাঁকায় পুড়ছে মানুষ। কোথায় প্রতিকার পাবেন জানেন না। কার কাছে নালিশ করবেন তাও অজানা। কয়েক সপ্তাহ ধরে ভোজ্যতেলের মূল্যে কোনোভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না। নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষের কষ্টের খবর এখন আর অজানা নয়। সবাইকেই বাজারে ঠকতে হয়। এমন বাস্তবতায় গতকাল বৃহস্পতিবার সরকারের কয়েকটি দপ্তর নড়েচড়ে বসে। সেটা লোক দেখানোই হোক, কিংবা জনস্বার্থেই হোক। দেশের মানুষের কাছে বার্তা একটা পৌঁছেছে যে ভোজ্যতেলের দাম আর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে না। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। প্রশাসনের একাংশ সরব হলেও আরেক অংশ তাল মিলায়। তারা সিন্ডিকেটের বাইরে নেই। কোনো না কোনোভাবে সুবিধার আওতায় আছেন পদে থাকা লোকজন। মাঝে বিপন্ন হয় সাধারণ মানুষ। ভোজ্যতেলের দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে ভোক্তা আদৌ সুফল পাবে কিনা- প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। কেননা অতীতেও বাজার নিয়ন্ত্রণে পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া ও তদারকি জোরদার করাসহ নানা উদ্যোগ নিলেও তার সুফল ভোক্তারা পাননি। বিশ্ব বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে দেশীয় বাজারে দফায় দফায় পণ্যটির দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কিছুদিন আগেও আরেক দফায় লিটারপ্রতি ১২ টাকা দাম বাড়ানো জোর চেষ্টা চালিয়েছেন তারা। কিন্তু সরকার ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব নাকচ করে দিলে বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দেয়। এ সময় রাজধানীর অনেক দোকানে গায়েব হয়ে যায়
সয়াবিন তেলের বোতল। যেখানে পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। রমজানের আগেই বাজারের এমন চিত্রে ভোক্তাদের দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে।
লাগাতার বাড়তে থাকা ভোজ্যতেলের দামে লাগাম টানতে পণ্যটির ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে সরকার। সয়াবিনের উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। পাশাপাশি আসন্ন রমজান উপলক্ষে চিনি ও ছোলার শুল্কও প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ভোজ্যতেলের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করতে এনবিআরকে চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতেই ভ্যাট প্রত্যাহারের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
গতকাল দুপুরে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অনলাইন ব্রিফিংয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। মূলত রমজান মাসে যেসব পণ্য বেশি প্রয়োজন, সেসব পণ্যের শুল্ক প্রত্যাহার হয়েছে। কারণ সবাই এগুলোর ভোক্তা। সয়াবিনের উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে।
সরকারের এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ভ্যাট প্রত্যাহারের এ সিদ্ধান্তের সুবিধা ভোক্তারা আদৌ পাবেন কিনা, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ভোজ্যতেলের বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু এতে ব্যবসায়ীরা সুবিধা পেলেও ভোক্তারা খুব একটা সুবিধা পাবেন না। কারণ ভোজ্যতেল বিক্রি হবে সর্বশেষ নির্ধারিত দাম অনুযায়ী। ভ্যাট প্রত্যাহারের পর নতুন করে দাম হয়তো বাড়বে না, কিন্তু যে দাম রয়েছে, সেটাও তো ভোক্তার নাগালের বাইরে। আন্তর্জাতিক বাজারে যে দাম রয়েছে, তাতে বর্তমান নির্ধারিত দামে সয়াবিন তেল বিক্রি করলে ব্যবসায়ীদের লোকসান হওয়ার কথা না। সুতরাং ভ্যাট প্রত্যাহারে ব্যবসায়ীদের সুবিধা হবে, ভোক্তারা খুব একটা সুফল পাবে না হয়তো।
ভ্যাট প্রত্যাহার হলে ভোক্তারা কতটা স্বস্তি পাবেন তা নিয়ে সন্দিহান রাজধানীর ধানমন্ডির ঝিগাতলা এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মো. মাসুদ রানা। তিনি বলেন, ‘বাজার খরচ সামাল দেওয়াটাই সবচেয়ে কঠিন ও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। খবরে শুনলাম তেল, চিনি ও ছোলার দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, এর সুবিধা আমরা পাব তো? নাকি বরাবরের মতো ব্যবসায়ীরাই সুবিধা ভোগ করবেন। এর আগেও সরকার বিভিন্ন পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু আমরা সুবিধা পাইনি। সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করেই বেশি দামে পণ্য বিক্রি হয়েছে।’
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমানও প্রশ্ন তোলেন, ‘ভোক্তারা ভ্যাট প্রত্যাহারের সুবিধা পাবেন তো?’ আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘সরকারের এ সিদ্ধান্ত অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু ভোক্তারা যাতে ভ্যাট প্রত্যাহারের সুবিধাটা পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ সাধারণত আমরা দেখতে পাই, শুল্ক প্রত্যাহার হলে ব্যবসায়ীরাই তার সুবিধা ভোগ করেন, ভোক্তারা সুফল পান না। তাই সরবরাহ ও বিপণনে নজরদারি থাকতে হবে। মূল্য সমন্বয়টাও যৌক্তিক কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। তদারকি না থাকলে ভোক্তারা বঞ্চিত হবেন। তাদের বেশি দামেই তেল কিনতে হবে।’
ক্যাবের মহাসচিব হুমায়ুন কবির ভুইয়া বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর যে অভিযান পরিচালনা করছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে। অভিযান আরও বেগবান করতে হবে। এতে ভোক্তারা কিছুটা হলেও উপকৃত হবেন। কেবল অভিযান চালালেই হবে না, দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। কারণ স্বল্প আয়ের মানুষকে রক্ষাই এখন সরকারের দায়িত্ব।
ভ্যাট প্রত্যাহারে বাজারে সয়াবিনের দামে কেমন প্রভাব পড়তে পারে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের অন্যতম বৃহৎ পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানের একজন পদস্থ কর্মকতা জানান, ভ্যাট প্রত্যাহার হয়েছে- এমন কোনো লিখিত কাগজ তারা পাননি। তাই এখনই বলা যাচ্ছে না যে, বাজারে কী প্রভাব পড়বে।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি দেশের বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১৪৩ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৬৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক শেষে এ দাম নির্ধারণ করে। নতুন দাম অনুযায়ী, বোতলজাত সয়াবিনের পাঁচ লিটার বোতল ৭৯৫ টাকা এবং প্রতিকেজি পাম তেল ১৩৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আবারও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার দোহাই দিয়ে সয়াবিনের দাম আরও বাড়াতে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে চিঠি দেন ব্যবসায়ীরা। চিঠিতে বলা হয়, ১ মার্চ থেকে নতুন দামে তেল বিক্রি করতে চান তারা। এ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, রমজানের আগে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হবে না। এরপর থেকেই অস্থির হতে শুরু করে বাজার। তেলের ‘সংকট’ দেখা দেয় বাজারে। বাজারে প্রতি লিটার বোতলজাত তেলের দাম এখন ১৭০ টাকা পর্যন্ত এবং পাঁচ লিটারের বোতলের দাম ৮৫০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে। সরকারি সংস্থা ট্রেড করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, মাসের ব্যবধানে এক লিটার বোতলের দাম প্রায় ৫ শতাংশ ও পাঁচ লিটারের বোতলের দাম সাড়ে ৬ শতাংশ বেড়েছে। বছরের ব্যবধানে যা যথাক্রমে প্রায় ২৯ শতাংশ এবং প্রায় ৩৪ শতাংশ।
এদিকে বাজারের অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে গত দুই সপ্তাহে বিপুল বাড়তি মুনাফা করে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ট্যারিফ কমিশনের তথ্যানুসারে, দেশে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা আছে, যার ৯০ শতাংশই পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। এ হিসাব অনুযায়ী দেশে প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার ৪৭৯ টন (৪৯ লাখ ৩১ হাজার ৫০৭ লিটার) তেলের চাহিদা রয়েছে। প্রতি লিটারে ১৭ টাকা বাড়তি দাম হিসাবে দৈনিক প্রায় ৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বাড়তি মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা। প্রকৃত চাহিদার হিসাবে এ মুনাফার পরিমাণ আরও বেশি।
ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে তিন সদস্যের একটি কমিটি করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। গতকাল সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাজারে সম্প্রতি ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি ও অস্থিরতা কমিশনের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ভোজ্যতেলের বাজারে প্রতিযোগিতা পরিপন্থী কর্মকা- ও কৃত্রিম সংকট বিষয়ে অনুসন্ধান কাজ পরিচালনার জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাজারে প্রতিযোগিতাবিরোধী কর্মকা- পরিলক্ষিত হলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সচিব বরাবর এ সংক্রান্ত তথ্য পাঠাতে সবাইকে আহ্বান জানানো হচ্ছে। তথ্য প্রদানকারীর পরিচয় গোপন রাখা হবে বলে জানানো হয়েছে।
সয়াবিন তেল বিক্রিতে ব্যবসায়ীদের কারসাজি ঠেকাতে সারাদেশের বিভিন্ন বাজারে তদারকি অভিযান পরিচালনা করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও। দীর্ঘদিন ধরে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগের আঙ্গুল ছিল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সিটি গ্রুপের তীর সয়াবিন তেলের গুদাম ও রূপচাঁদা ওয়েল মিলে অভিযান চালায় ভোক্তা অধিদপ্তর। বেলা ১১টা থেকে এ অভিযান শুরু হয়। ভোক্তা অধিদপ্তরের পরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারের নেতৃত্বে অভিযানে উপস্থিত ছিলেন সহকারী পরিচালক আবদুর জব্বার ম-ল, ফাহমিনা আক্তার ও সেলিমুজ্জামান। অভিযানে তেল আমদানি ও সরবরাহের হিসাব স্বাভাবিক পেয়েছে সংস্থাটি।
এদিকে আসন্ন রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে এক কোটি ৭১ লাখ ১৫ হাজার ৬৫২ লিটার সয়াবিন তেল কেনার অনুমোদন দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি ১৪ হাজার টন চিনি, ১০ হাজার টন ছোলা এবং ১৯ হাজার ৫০০ টন মসুর ডাল ক্রয়ের চারটি প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৯১ কোটি ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৫৩৬ টাকা।